বাংলাদেশের পার্লারগুলোর এই সমস্যা আজকের নয়, এটি একটি পুরনো সমস্যা। ছেলেরা চুল কাটাতে গিয়ে এমন সমস্যায় পড়ে কিনা জানিনা কিন্তু আমি ঢাকাতে যখনই চুল কাটাতাম এবং যার কাছেই কাটাতাম তাকেই আমার বারবার মনে করিয়ে দিতে হত যেন চুল বেশি কেটে না ফেলে। আমি সবসময় চুল একটু ছোট রাখি তাই খেয়াল রাখতে হয় খুব বেশি ছোট না হয়ে যায়। যাই হোক, মুখে ফেনা তুলে ফেলার পরও বেশিরভাগ সময়ই তারা চুল বেশি কেটে ফেলত। দেড় বছর আগে ঢাকা গিয়ে এই একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম, আমার শিক্ষা হওয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু হয়নি। এবার ঢাকাতে গিয়ে পার্লারে গেলাম মেয়ের চুল কাটাতে। আমার আউল-বাউল মেয়ে চুল বাঁধতে পছন্দ করেনা, চুল আঁচড়াতেও নয়। সারাদিন মাথা ঘামে ভিজে জবজবা। যদিও সে নির্বিকার, কিন্তু তার বাবা, নানা, নানু এতে মহাচিন্তিত -- বাচ্চাটার ঠান্ডা না লেগে যায়! মেয়েকে নিয়ে গেলাম পার্লারে চুল ছোট করাতে। রিসেপশনের মেয়েটি এবং হেয়ার স্টাইলিস্ট আমাকে নানাভাবে পটিয়ে ফেলল - আমিও নিজের জন্য একটা হেয়ারকাট নিয়ে ফেললাম। চেয়ারে বসিয়ে হেয়ার স্টাইলিস্ট আমার সাথে অনেক গল্প করল যার সারমর্ম মোটামুটি এমন: বিদেশের পার্লারগুলোর কাজ বাংলাদেশের পার্লারের তুলনায় খুবই নিম্মমানের। আমাদের দেশের মেয়েরা কোনভাবে আমেরিকা যেতে পারলে হাজার হাজার ডলার কামাই করতে পারত। তারা যে পরিমাণ কাজ জানে তার ধারে কাছের কিছু সেখানকার মেয়েরা জানেনা।
স্টাইলিস্ট তার এক্সপার্ট অপিনিয়ন দিল, জানাল যে আমার বর্তমান হেয়ারকাট মোটামুটি মানের। কিন্তু সে যেটা করে দিবে সেটা হবে দেখার মত। আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রইলাম সেই মনমুগ্ধকর হেয়ারকাট দেখবার জন্য। সে কচকচ করে কাঁচি চালাতে চালাতে কানাডাপ্রবাসী এক মহিলার কথা বলল যে তাকে কথা দিয়েছিল তাকে কানাডা নিয়ে যাবে কিন্তু পরে আর তার সাথে যোগাযোগ না থাকায় সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। জানলাম যে ১২ বছর ধরে সে চুল কাটছে। চুল কাটা ছাড়াও আরও অনেক কাজ সে জানে। আমি তাকে বললাম যে বাংলাদেশের পার্লারগুলো আসলেই ভালো। বাংলাদেশে এসে পার্লারে কোন কাজ করিয়ে অন্য রকম একটা আনন্দ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মেয়েরা অনেক কাজ জানে ঠিকই কিন্তু বিদেশে চুল কাটতে চাইলে বিউটি কলেজে যাওয়া লাগে, লাইসেন্স নিতে হয় এবং সেই লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন করতে হয়। সে আমার কথা তেমন কিছু বুঝল বলে মনে হল না, শুধু সরলভাবে বলল, "ইংরেজিটা জানলে আজকে বিদেশে গিয়ে কত ভাল ভাল কাজ করতে পারতাম! ঐখানে তো ঘন্টায় টাকা দেয়।"
চুল কাটা শেষ হবার পর আয়নায় নিজেকে দেখে আমার চোখে পানি চলে আসল। আমার মাথার অর্ধেক চুল পার্লারের মেঝেতে, আর বাকিটুকু আমার মাথায়। সে যখন চুল কাটছিল তখন আমি বুঝতেই পারিনি যে কি দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা। স্টাইলিস্ট কিন্তু তার নিজের কাজ নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট, সে বিজয়ের হাসি হেসে বলল, আপু, আগামী ছয় মাস আপনার আর পার্লারে যাওয়া লাগবে না। ঐখানে কত টাকা লাগে চুল কাটাইতে, শুধুশুধু ক্যান টাকা খরচ করবেন? (অতি যুক্তিসংগত কথা। আগে ওভাবে চিন্তা করলে আমি হয়তো বলতাম একেবারে ন্যাড়াই করে দিন - কম সে কম এক বছর চুল কাটাকাটি নিয়ে আর কোন টেনশনই করতে হবেনা আমাকে)
কিন্তু আমি তাকে কিছু বলতে পারলাম না, কেন বলতে পারলাম না জানিনা। রাগে গা কিরকির করছিল তাও কিছু বলতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল দোষটা আমারই। আমি জানি এরা যতটুকু বলি তার চাইতেও বেশি চুল প্রতিবার কেটে ফেলে কিন্তু সেটা জেনেও আমি রাজি হয়েছি চুল কাটাতে। ১০০ টাকা বখশিশ দিয়ে মনে মনে নিজেকে বকতে বকতে মেয়েকে নিয়ে পার্লার থেকে বের হয়ে এলাম।
আপাতত চুলে ক্যাস্টর আর অলিভ অয়েল লাগাচ্ছি, চুলে উল্টো করে আচঁড়াচ্ছি, হেয়ার প্যাক দিচ্ছি এই আশায় যে চুলগুলো দ্রুত বড় হয়ে যাবে - মনে হচ্ছে কাজ হচ্ছে। প্রথম এক সপ্তাহ চুল বেঁধে রেখেছিলাম, এখন খোলা রাখার সাহস পাচ্ছি।
Comments